গর্ভাবস্থায় বমি বা মর্নিং সিকনেস

গর্ভাবস্থায় বমি বা মর্নিং সিকনেস

গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া খুবই পরিচিত একটি সমস্যা।অধিকাংশ গর্ভবতী নারীরই এই সমস্যা দেখা দেয়।গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব (Morning Sickness) সাধারণত গর্ভাবস্থার ৬ সপ্তাহ থেকে শুরু হতে পারে।গর্ভাবস্থায় মর্নিং সিকনেস হওয়ার প্রবণতা সাধারণত প্রথমবার গর্ভবতী হওয়া নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, কারণ তাদের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ও নতুন অভিজ্ঞতার কারণে এমনটা হয়।তবে, মর্নিং সিকনেস যে কারো হতে পারে এবং এর তীব্রতা একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়।

গর্ভাবস্থায় কখন থেকে বমি বমি ভাব হতে পারে?

• এটি ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর শুরু হতে পারে।
• আবার অনেকের মাসিক বন্ধ হওয়ার ২-৩ সপ্তাহ পর (অর্থাৎ, গর্ভধারণের ৩-৪ সপ্তাহ পর) লক্ষণগুলি স্পষ্টভাবে দেখা যেতে শুরু করে।

বেশিরভাগ নারীর ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার ৯ সপ্তাহের কাছাকাছি সময়ে বমি বমি ভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়।

এই বমি বমি ভাব দিনের যেকোনো সময় হতে পারে, কেবল সকালে নয়। সাধারণত, গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক (First Trimester) অর্থাৎ প্রায় ১৩ থেকে ১৪ সপ্তাহ পার হওয়ার পর এটি ধীরে ধীরে কমে আসে।

গর্ভধারণের পর পরই অনেকের বমি বমি ভাব ও বমি দেখা দেয়, তাই অনেকে মনে করেন যে এটি হয়তো গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ। তবে সব গর্ভবতী নারীরই বমির সমস্যা দেখা দেয় না। সেটাও খুব স্বাভাবিক। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

গর্ভাবস্থায় বমি ভাব বা 'মর্নিং সিকনেস' (Morning Sickness) খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই এই সমস্যা কমে যায়। এর চিকিৎসার জন্য কিছু জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করার প্রয়োজন হতে পারে।

সাধারণ প্রতিকার ও জীবনধারা পরিবর্তন:

খাবারের অভ্যাস পরিবর্তন:
         একবারে বেশি খাবার না খেয়ে দিনে বারবার অল্প অল্প করে খাবার খান।

          সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে বিস্কুট বা শুকনো টোস্ট জাতীয় হালকা কিছু খেতে পারেন।

          তেল-চর্বিযুক্ত, ঝাল, মশলাদার এবং ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন।

          সহজে হজম হয় এমন খাবার যেমন - কলা, ভাত, টোস্ট, আপেলসস ইত্যাদি খেতে পারেন।

• পানি পান:

          দিনেরাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি, ফলের রস বা অন্যান্য পানীয় পান করুন। ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা এড়িয়ে চলুন।

          খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি পান না করে কিছুক্ষণ পর পান করুন।

          ঠান্ডা পানীয় বা বরফের টুকরা মুখে রাখলে বমি ভাব কমতে পারে।

• আদা (Ginger) এবং লেবু (Lemon):

          আদা বমি ভাব কমাতে খুব উপকারী। আদা চা, আদা দেওয়া ক্যান্ডি বা স্যুপে কুচি করা কাঁচা আদা খেতে পারেন।

          লেবুর খোসার গন্ধ বা মধুর সাথে লেবু জল পান করলে উপকার পেতে পারেন।

• বিশ্রাম এবং অন্যান্য টিপস:

         পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, কারণ ক্লান্তি বমি ভাব বাড়িয়ে দিতে পারে।

         খাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়বেন না। কিছুক্ষণ সোজা হয়ে বসে থাকুন বা হালকা হাঁটাহাঁটি করুন।

         যেসব গন্ধ বা জিনিস বমি ভাব বাড়ায়, সেগুলো এড়িয়ে চলুন।

         যদি প্রসবপূর্ব ভিটামিন (prenatal vitamins) খাওয়ার পর বমি ভাব হয়, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রাতে বা হালকা নাস্তার সাথে ওষুধটি খেতে পারেন।

চিকিৎসার প্রয়োজন হলে:

যদি বমি ভাব খুব তীব্র হয় বা বমির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয় (যাকে হাইপার এমেসিস গ্র্যাভিডেরাম - Hyperemesis Gravidarum বলা হয়), তবে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এই ক্ষেত্রে নিচের চিকিৎসা গুলো লাগতে পারে:

.    ওষুধ সেবন: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মেক্লিজিন, ডক্সিলামাইন, পাইরিডক্সিন (ভিটামিন বি৬) বা অন্যান্য বমি এবং অ্যাসিডিটির ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।

      হাসপাতালে ভর্তি: মাত্রাতিরিক্ত বমি বা পানিশূন্যতা দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শিরাপথে স্যালাইন, বমি বন্ধ করার ইনজেকশন, এবং ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন-সি সাপ্লিমেন্টেশন নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় কোনো ধরনের ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট (এমনকি ভিটামিনও) চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা উচিত নয়।

বমি ভাব কমানোর ঔষধ

ঘরোয়া পরামর্শগুলো ঠিকমতো মেনে চলার পরেও বমির সমস্যা না কমলে কিছু ঔষধ খেতে পারেন। গর্ভাবস্থায় বমি ভাব কমানোর জন্য ভিটামিন বি৬ বা পাইরিডক্সিন ব্যবহার করা হয়। এটি গর্ভাবস্থারবমি ভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গর্ভকালীন বমি ভাব ও বমি কমাতে এই ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেয়।

ভিটামিন বি৬ একটি ওভার দা কাউন্টার ঔষধ। ফার্মেসি থেকে কিনে নিরাপদে সেবন করতে পারবেন। এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।ভিটামিনের পাশাপাশি বমি ভাব কমাতে ডাক্তার আপনাকে ডক্সিলঅ্যামিন নামের একটি ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। এই অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধটি গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ বলে বিবেচনা করা হয়। এটি  আলাদাভাবে সেবন করা যায়, আবার পাইরিডক্সিন মেশানো অবস্থায় একত্রেও কিনতে পাওয়া যায়। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এটা সেবন করা যাবে না।এসব ঔষধে কাজ না হলে ডাক্তার আপনাকে বমির জন্য নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। ফার্মেসিতে অনেক ধরনের বমির ঔষধ পাওয়া যায়৷ এগুলো সাধারণত ট্যাবলেট হিসেবে সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে যদি সব ধরনের খাবার ও পানীয় বমি হয়ে যেতে থাকে তাহলে সাপোজিটরি অথবা ইনজেকশন হিসেবেও বমির ঔষধ দেওয়া হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় মর্নিং সিকনেস হওয়ার প্রবণতা সাধারণত প্রথমবার গর্ভবতী হওয়া নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, কারণ তাদের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ও নতুন অভিজ্ঞতার কারণে এমনটা হয়। তবে, মর্নিং সিকনেস যে কারো হতে পারে এবং এর তীব্রতা একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। 

কাদের বেশি হয়

• প্রথমবার গর্ভবতী নারী: প্রথমবার গর্ভধারণ করলে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ও নতুন পরিস্থিতির কারণে বমি বমি ভাব বেশি হতে পারে।

   

• হরমোন পরিবর্তনের কারণে: গর্ভাবস্থায় শরীরে বিটা-এইচসিজি (β-hCG) হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে বমি ভাব বা বমি হতে পারে।

   

• অন্যান্য কারণ: মানসিক চাপ, ক্লান্তি বা গর্ভাবস্থার প্রাথমিক অন্যান্য লক্ষণের কারণেও এটি হতে পারে। 
   

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

• স্বাভাবিক এবং সাধারণ: গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে মর্নিং সিকনেস বা সকালের অসুস্থতা একটি স্বাভাবিক উপসর্গ।

   

• দিনের যেকোনো সময়: নামটি 'মর্নিং সিকনেস' হলেও, দিনের যেকোনো সময়েই এই বমি বমি ভাব হতে পারে।

• গুরুতর হলে: যদি বমি খুব বেশি হয়, ওজন কমতে থাকে, বা পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। 

বমি বমি ভাব হওয়ার কারণ কী?

গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের তারতম্য বমি বমি ভাবের অন্যতম কারণ বলে ধারণা করা হয়।এ ছাড়া আরও কিছু অসুখের কারণেও বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে। যেমন—

• পেটের আলসার
• ফুড পয়জনিং
• থাইরয়েডের রোগ
• পিত্তথলির রোগ। যেমন: পিত্তথলিতে পাথর হওয়া

• কিডনির ইনফেকশন।সঠিক চিকিৎসার অভাবে প্রস্রাবের ইনফেকশন কিডনিতে ছড়িয়ে গিয়ে বমি বমি ভাব কিংবা বমি হতে পারে

   

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

বমির সাথে নিচের কোনো লক্ষণ থাকলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন—

রক্তবমি হলে

• প্রস্রাবের রঙ অনেক গাঢ় হলে অথবা ৮ ঘন্টার বেশি সময়ের মধ্যে প্রস্রাব না হলে
• ২৪ ঘন্টার মধ্যে যা খাচ্ছেন কিংবা পান করছেন তার সবকিছুই বমি হয়ে গেলে
• শরীর প্রচণ্ড দুর্বল লাগলে
• মাথা ঘুরালে অথবা দাঁড়ানোর সময়ে অজ্ঞান হয়ে যাবেন এমনটা মনে হলে
• পেটে ব্যথা থাকলে
• জ্বর থাকলে
• মাথাব্যথা থাকলে
• প্রস্রাবের সময়ে ব্যথা হলে
• ওজন কমে গেলে

এগুলো পানিশূন্যতা, প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন অথবা কোনো গুরুতর রোগের লক্ষণ হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি আপনার শারীরিক পরীক্ষা করবেন, প্রেসার মেপে দেখবেন এবং কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিবেন। যেমন: রক্ত পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষা ও পেটের আলট্রাসনোগ্রাম।

হাসপাতালে ভর্তি করা হলে আপনাকে শিরায় স্যালাইন দেওয়া হতে পারে। সেই সাথে বমির ঔষধ ও অন্যান্য ভিটামিন আপনার শরীরে ইনজেকশন হিসেবে দেওয়া হতে পারে। এমন চিকিৎসার পরে অনেকে সুস্থ বোধ করেন এবং দ্রুত বাড়ি ফিরে যেতে পারেন।