গর্ভের শিশুর অ্যানোমালি স্ক্যান

গর্ভের শিশুর অ্যানোমালি স্ক্যান

অ্যানোমালি স্ক্যান হলো গর্ভাবস্থায় করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান, যা সাধারণত ১৮ থেকে ২১ সপ্তাহের মধ্যে করা হয়।এটিকে ২০-সপ্তাহের স্ক্যান বা অ্যানাটমি স্ক্যানও বলা হয়।ফলে অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়, শিশুর জন্ম-পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আগেভাগে পরিকল্পনা করে রাখা যায়। এর পাশাপাশি শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা এবং শিশু ছেলে না কি মেয়ে—এই সংক্রান্ত তথ্যও জানা সম্ভব হয়।

অ্যানোমালি স্ক্যান কী?

অ্যানোমালি স্ক্যান হলো গর্ভাবস্থায় করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান,যা সাধারণত ১৮ থেকে ২১ সপ্তাহের মধ্যে করা হয়।এটিকে ২০-সপ্তাহের স্ক্যান বা অ্যানাটমি স্ক্যানও বলা হয়।এর মূল উদ্দেশ্য:

• শিশুর শারীরিক গঠন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরীক্ষা: এই স্ক্যানের প্রধান লক্ষ্য হলো গর্ভের শিশুর মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড, হৃৎপিণ্ড, মুখমণ্ডল, কিডনি, হাত-পা এবং অন্যান্য প্রধান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হচ্ছে কিনা তা বিস্তারিতভাবে দেখা।

• জন্মগত ত্রুটি (Congenital Anomalies) সনাক্তকরণ: স্ক্যানটি শিশুর মধ্যে গুরুতর কোনো জন্মগত বা কাঠামোগত ত্রুটির (structural anomaly) লক্ষণ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে।যেমন: স্পাইনা বিফিডা,অ্যানেন্সেফালি,বা কিছু ধরণের হৃদপিণ্ডের ত্রুটি।

   

• বৃদ্ধি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পর্যবেক্ষণ:
  • শিশুর আকার ও বৃদ্ধি পরিমাপ করা।
  • গর্ভফুলের (placenta) অবস্থান পরীক্ষা করা।
  • অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের (amniotic fluid - গর্ভের জল) পরিমাণ দেখা।
  • রক্তের প্রবাহ এবং নাভিরজ্জু (umbilical cord) পরীক্ষা করা।

অ্যানোমালি স্ক্যান কীভাবে করা হয়?

অ্যানোমালি স্ক্যান (Anomaly Scan), যা ২০-সপ্তাহের স্ক্রিনিং স্ক্যান বা অ্যানাটমি স্ক্যান নামেও পরিচিত, এটি হলো গর্ভবতী মায়ের পেটের ওপর করা একটি বিশেষ ধরনের আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান।

এটি একটি অ-আক্রমণকারী (non-invasive) পদ্ধতি, যার মাধ্যমে গর্ভের শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং গঠনগত দিকগুলি বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করা হয়।

স্ক্যান পদ্ধতি

অ্যানোমালি স্ক্যান সাধারণত নিম্নলিখিত উপায়ে করা হয়:

• প্রস্তুতি: স্ক্যানের জন্য সাধারণত বিশেষ কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না।মা'কে ঢিলেঢালা পোশাক পরতে বলা হয় যাতে সহজে পেটে স্ক্যান করা যায়।অনেক ক্ষেত্রে পরিষ্কার ছবি পেতে স্বল্প পরিমাণে পূর্ণ মূত্রথলি নিয়ে আসতে বলা হতে পারে।

   

• অবস্থান: গর্ভবতী মাকে একটি পরীক্ষার বিছানায় শুয়ে পড়তে বলা হয় এবং পোশাক সরিয়ে পেট উন্মুক্ত করতে হয়।

   

• জেল প্রয়োগ: স্ক্যান করার স্থানে,সাধারণত পেটের ওপর, ঠান্ডা জেল (Ultrasound Gel) লাগানো হয়। এই জেল শব্দ তরঙ্গকে ত্বকের মাধ্যমে শিশুর কাছে পৌঁছাতে এবং প্রতিধ্বনিকে ফেরত আসতে সাহায্য করে, যার ফলে পরিষ্কার ছবি তৈরি হয়

   

• স্ক্যান করা: একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী (সোনোগ্রাফার) একটি হ্যান্ডহেল্ড ডিভাইস, যাকে প্রোব বা ট্রান্সডিউসার বলা হয়, সেটিকে পেটের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে থাকেন।

   

• পর্যবেক্ষণ: প্রোব শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে গর্ভের শিশুর স্ক্রিনে ছবি তৈরি করে। সোনোগ্রাফার এই ছবি দেখে শিশুর মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, মেরুদণ্ড, মুখমণ্ডল, কিডনি, পেট এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করেন এবং সেগুলির পরিমাপ নেন। শিশুর কোনো জন্মগত ত্রুটি বা অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা দেখেন।

   

• সময়কাল: স্ক্যানটি সাধারণত ৩০ মিনিট থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত সময় নিতে পারে। শিশু যদি ঠিক মতো অবস্থানে না থাকে বা খুব বেশি নড়াচড়া করে, তাহলে স্পষ্ট ছবি পাওয়ার জন্য সোনোগ্রাফার মা'কে একটু হেঁটে আসতে বা কিছু পান করে আসতে বলতে পারেন।

   

• নিরাপত্তা: এই স্ক্যানটি মা এবং শিশুর জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে মনে করা হয়।

অ্যানোমালি স্ক্যানে কী কী দেখা হয়?

অ্যানোমালি স্ক্যানের সময়ে শিশুর মুখমণ্ডল, হাত-পা, পেট ও নাড়িভুঁড়ি, হাড়, হার্ট, কিডনি, ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়। এই স্ক্যানে জন্মগত ত্রুটি বা ‘অ্যানোমালি’ বের করার পাশাপাশি অনেকগুলো তথ্য পাওয়া যায়। যেমন—

• গর্ভের শিশুর আকার ও ওজন
• গর্ভফুলের অবস্থান
• শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে গড়ে উঠছে কি না
• শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক হারে চলছে কি না
• শিশু ছেলে না কি মেয়ে। এই তথ্য জানতে চাইলে স্ক্যানের শুরুতে ডাক্তারকে জানিয়ে রাখবেন। সেই সাথে মনে রাখবেন, শিশুর অবস্থানসহ বিভিন্ন কারণে শিশুর লিঙ্গ নিশ্চিত করা সম্ভব না-ও হতে পারে

জন্মগত ত্রুটিগুলো নিয়ে আর্টিকেলের পরের অংশে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

এই পরীক্ষাটি কতটুকু নির্ভরযোগ্য?

অ্যানোমালি স্ক্যান (Anomaly Scan), যা আলট্রাসাউন্ড লেভেল ২ বা ২০-সপ্তাহের স্ক্যান নামেও পরিচিত, এটি গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটি বা অস্বাভাবিকতা নির্ণয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণত নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা।

এই স্ক্যানের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে কিছু মূল তথ্য নিচে দেওয়া হলো:

• উচ্চ সনাক্তকরণ হার: এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত অস্বাভাবিকতা (Structural Abnormalities) সনাক্ত করতে অত্যন্ত কার্যকর। গবেষণায় দেখা যায় যে, নির্দিষ্ট কিছু ত্রুটি যেমন—

ওপেন স্পাইনা বিফিডা' (মেরুদণ্ডের ত্রুটি) প্রায় ৯০% থেকে ৯৫% ক্ষেত্রে নির্ণয় করা যায়।

ক্লেফট লিপ বা প্যালেট' (ঠোঁট বা তালুর ফাটল) প্রায় ৮০% ক্ষেত্রে সনাক্ত করা যেতে পারে।

জন্মগত হৃৎপিণ্ডের সমস্যা ৬০% থেকে ৭০% ক্ষেত্রে নির্ণয় করা সম্ভব।

ডাউন সিনড্রোমের (Down Syndrome) মতো জিনগত ঝুঁকির ক্ষেত্রে ৫০% থেকে ৭০% পর্যন্ত ধারণা দেওয়া সম্ভব (তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অন্যান্য পরীক্ষা প্রয়োজন)।

• সীমাবদ্ধতা: যদিও এটি অত্যন্ত কার্যকর, তবুও অ্যানোমালি স্ক্যান সব ধরনের অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করতে পারে না। যেমন:

   

মেটাবলিক ডিসঅর্ডার বা বুদ্ধিবৃত্তিক ত্রুটির মতো কার্যগত সমস্যা (Functional Problems) নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।

কিছু ত্রুটি গর্ভাবস্থার পরবর্তী সময়ে বিকশিত হতে পারে বা স্ক্যান করার সময় শিশুর অবস্থান সুবিধাজনক না হলে তা এড়িয়ে যেতে পারে।

স্ক্যান করার সময় মায়ের অতিরিক্ত ওজন, পেটে অতিরিক্ত চর্বি বা ভ্রূণের চারপাশে অ্যামনিওটিক তরলের পরিমাণ বেশি হলে প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট না আসার কারণে নির্ভুলতা কম হতে পারে।

• নির্ভরতা নির্ভর করে: স্ক্যানের নির্ভরযোগ্যতা নির্ভর করে যন্ত্রের আধুনিক প্রযুক্তি, সোনোগ্রাফারের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা এবং শিশুর সঠিক অবস্থান ইত্যাদির ওপর।

সার্বিক দিক বিবেচনায়, অ্যানোমালি স্ক্যান হলো একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্ক্রিনিং টেস্ট যা গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দেয়। তবে, মনে রাখতে হবে, এটি একটি স্ক্রিনিং পরীক্ষা, যা অস্বাভাবিকতার ঝুঁকি বা উপস্থিতি নির্দেশ করে। ১০০% নিশ্চয়তা দিতে পারে না, এবং চূড়ান্ত রোগ নির্ণয়ের জন্য মাঝে মাঝে অতিরিক্ত বা আরও উন্নত পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।

জন্মগত ত্রুটি ধরা পড়লে করণীয় কী?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো গর্ভের শিশুর সবকিছু স্বাভাবিক থাকবে। তবে স্ক্যানের সময়ে যদি কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে অথবা ডাক্তার সন্দেহ করেন যে শিশুর কোনো জন্মগত ত্রুটি আছে, তাহলে—

ডাক্তার রিপোর্ট নিয়ে আরেকজন সনোলজিস্ট বা আলট্রাসনোগ্রাফি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন

পুনরায় আলট্রাসনোগ্রাফি করার পরামর্শ দিতে পারেন

যে ধরনের ত্রুটি ধরা পড়েছে বা সন্দেহ করা হচ্ছে, তার ভিত্তিতে আরও কিছু পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। যেমন: রক্ত পরীক্ষা, গর্ভের ভেতর থেকে কোষ অথবা পানি নিয়ে পরীক্ষা

পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে আপনার গাইনী ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। তিনি পরবর্তী করণীয়ের ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারবেন, ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।

অ্যানোমালি স্ক্যান (Anomaly Scan), যা সাধারণত গর্ভাবস্থার ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে করা হয়, এর মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশুর বিভিন্ন গঠনগত ত্রুটি বা অস্বাভাবিকতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। এই স্ক্যানে যেসব জন্মগত ত্রুটি ধরা পড়তে পারে, তার মধ্যে কিছু প্রধান ত্রুটি নিচে উল্লেখ করা হলো:

প্রধান জন্মগত ত্রুটিসমূহ:

• মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের ত্রুটি (Neural Tube Defects):

   

  • এনেনকেফালি (Anencephaly): মস্তিষ্কের এবং মাথার খুলির একটি বড় অংশ অনুপস্থিত থাকা। এটি গুরুতর ধরনের ত্রুটি।
  • স্পাইনা বাইফিডা (Spina Bifida): মেরুদণ্ডের গঠন ঠিকমতো না হওয়া (নিউরাল টিউব ডিফেক্ট)।
  • হাইড্রসেফালাস (Hydrocephalus): মস্তিষ্কের মধ্যে অতিরিক্ত তরল জমা হওয়া।
     

• মুখ ও ঘাড়ের ত্রুটি

  ক্লেফট লিপ বা তালু কাটা (Cleft Lip and Palate): ঠোঁট বা তালুর সঠিক গঠন না হওয়া

   

• হৃদযন্ত্রের ত্রুটি (Congenital Heart Defects):

হৃদপিণ্ডের গঠনগত গুরুতর অস্বাভাবিকতা, যেমন হৃদপিণ্ডের প্রকোষ্ঠ বা ভাল্ভের ত্রুটি।

• পেটের অঙ্গের ত্রুটি (Abdominal Wall Defects):

গ্যাস্ট্রোস্কিসিস (Gastroschisis): নাভির পাশে পেটের প্রাচীরে একটি ছিদ্র থাকে, যার মাধ্যমে অন্ত্রগুলো বাইরে বেরিয়ে আসে।

ওমফালোসিল/এক্সমফালোস (Exomphalos/Omphalocele): পেটের প্রাচীরের একটি ত্রুটি যেখানে পেটের অঙ্গগুলি একটি পাতলা থলির মধ্যে নাভির মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে আসে।

• কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের ত্রুটি:

বাইল্যাটারাল রেনাল এজেনেসিস (Bilateral Renal Agenesis): দুটি কিডনিই অনুপস্থিত থাকা।

কিডনি বা মূত্রাশয়ের অন্যান্য বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা।

হাড় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ত্রুটি: বাইল্যাটারাল রেনাল এজেনেসিস (Bilateral Renal Agenesis): দুটি কিডনিই অনুপস্থিত থাকা।

কিডনি বা মূত্রাশয়ের অন্যান্য বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা।

• হাড় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ত্রুটি:

গুরুত্বর হাড়ের বিকৃতি (Severe Skeletal Dysplasia)।

হাত-পায়ের গঠনে অস্বাভাবিকতা, যেমন ছোট বা বিকৃত অঙ্গ।

অন্যান্য গুরুতর ত্রুটি:

• ডায়াফ্রাগম্যাটিক হার্নিয়া (Diaphragmatic Hernia): বুক ও পেটকে বিভক্তকারী পেশীতে (ডায়াফ্রাম) ত্রুটি, যার ফলে পেটের অঙ্গগুলো বুকে চলে যেতে পারে।

• কিছু ক্রোমোজোমজনিত অস্বাভাবিকতার ঝুঁকি (যেমন ডাউন সিনড্রোম, এডওয়ার্ডস সিনড্রোম, পাটাউ সিনড্রোম) এর সাথে সম্পর্কিত কিছু শারীরিক লক্ষণ এই স্ক্যানে দেখা যেতে পারে। তবে ক্রোমোজোমজনিত ত্রুটি নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়।

   

অ্যানোমালি স্ক্যান একটি স্ক্রিনিং পরীক্ষা, যা গর্ভের শিশুর গঠনগত ত্রুটি নির্ণয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এটি শতভাগ নির্ভুলভাবে সব ত্রুটি খুঁজে বের করতে পারে না। কিছু ত্রুটি ছোট হওয়ায় বা স্ক্যান করার সময় স্পষ্টভাবে বোঝা না যাওয়ার কারণে ধরা নাও পড়তে পারে।